আসুন একটু দেখি আমরা কতটা
ফ্যাক্ট-ডিপ্রাইভড ব্রেইন নিয়ে চলাফেরা করি, লেখালেখি করি, নিজেদের সত্যকে চলতে-ফিরতে
অস্বীকার করি। অনেক আওয়ামী লীগার ও মুজিব সৈনিকরাও এ বিষয়ে স্বয়ং সুষ্ঠু ধারণা রাখেন
না বলে আমার বিশ্বাস; তারাও ভাবে মুজিববাদ মানে সাধারণ অংশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের
প্রতি সম্মান প্রদর্শন।’
“‘মুজিববাদ’ হল একটি রাজনৈতিক
ধারণা যা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও দর্শনের উপর
ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি মূলত তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
এবং তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পর্কিত। মুজিববাদ বাংলাদেশের
উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি গুলোকে কেন্দ্র
করে গড়ে উঠেছে।
মুজিববাদের মূল উপাদান:
১. জাতীয়তাবাদ: বঙ্গবন্ধুর
নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম।
২. গণতন্ত্র: জনগণের ক্ষমতা
ও অধিকারের প্রতি অঙ্গীকার।
৩. সমাজতন্ত্র: বৈষম্যহীন
ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা: ধর্মের
ভিত্তিতে বিভাজন এড়িয়ে একটি সাম্যের সমাজ গঠন।
৫. উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতা:
দারিদ্র্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ।
এটি একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক
পথপ্রদর্শক হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে একটি রূপরেখা প্রদান
করে।”
উক্ত উত্তরটি চ্যাট জিপিটি
জেনারেটেড, প্রশ্ন করেছিলাম ‘মুজিববাদ কি?’ গুগলে আমরা যদি সেম জিনিস সার্চ করি, উত্তর
আসবে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪টি স্তম্ভ হল মুজিববাদ; ১) সমাজতন্ত্র, ২) গণতন্ত্র,
৩) জাতীয়তাবাদ, ৪) ধর্মনিরপেক্ষতা-যা উইকিপিডিয়াতে আছে।
এখন বলুন, তার আগে ধরে
নিলাম বর্তমান সুশীলদের এক অংশ এবং বাম ও নতুন প্রজন্মের ‘wannabe leftist’ যারা তথাকথিতভাবে
কোনো একভাবে ’৭১-এ বিশ্বাসী। আমার এই ইক্যুয়েশনে আরো আসবে যারা বলে, “আওয়ামী লীগ
’৭১ বেচে খাইছে; / ’৭১ তাদের বাপের সম্পত্তি না; / দেশটা হাসিনার বাপের না; / জাতীয়
৪ নেতা ও সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী এবং শের-এ-বাংলাকে যথা্যথ সম্মান দেয়া হয় না; / মুজিব
থেকে তাজউদ্দীনকে পাকিরা বেশি ভয় পেত; / মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা ৭ মার্চে দেয়নি; /
মুজিব সোহরাওয়ার্দীর বডিগার্ড ও মুসলিম লীগের পাতিনেতা ছিল।”
আমাদের স্বাধীনতা ছিল পাকিদের
শোষণ ও মিলিটারি স্বৈরাচারীতার বিরুদ্ধে আমাদের বাঙালি জাতির অর্জন। দেশের অথরিটেটিভ
বডি ও আর্মি থেকে শুরু করে প্রত্যেক পর্যায়ে এমন কি বৈদেশিক রিলিফ ফান্ড ডিস্ট্রিবিউশনে
ওয়েস্টপাক থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে এই বঙ্গদেশকে বঞ্চিত করা হত; এজন্য প্রয়োজন ছিল
‘গণতন্ত্রের’।
সোহরাওয়ার্দী বা ভাসানীর
মত যুক্তফ্রন্ট বা মুসলিম লীগের নেতারা এক সময়ে ‘বাঙালি (পুর্ব পাকিস্তানি) মুসলি’
কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির জন্য লড়াই করেছে, কিন্তু পরবর্তীতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরো
বাঙালিদের ‘অধিকার’-এর জন্যই ছিল তাদের ’৪৭ পরবর্তী লড়াই যা তুলে ধরে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’
শেকড়, যা মুজিববাদের ৪ স্তম্ভের একটি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান ছিল সোহরাওয়ার্দীর আদর্শ শিষ্য এবং তাঁদের সম্পর্ক যতটাই না রাজনৈতিক আদর্শে
একক ছিল যতই তাঁর লিডার সোহরাওয়ার্দীর আদর্শ ‘পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদ ঘেষা’ হোক, তার
থেকেও বেশি ছিল ব্যক্তিগত তাই নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবিদ যারা তাদের তুলনা দেয় বা কনফ্লিক্টেড
আইডোলজিকাল ওয়ার করার চেষ্টা করে তাদের উচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ একবার পড়া যাতে করে
জানা যায় মুজিবের তার নেতা সোহরাওয়ার্দীর প্রতি কতটা ভালোবাসা ছিল।
আগরতলা মামলায় আত্মপক্ষ
সমর্থনস্থল জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “১৯৪৯ সালে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর
নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল।” এ উক্তিতে নিতান্তভাবেই সে স্বীকার করেন সোহরাওয়ার্দীকেই
তিনি তাঁর প্রধান ও প্রথম নেতা বলেই মানতেন। মাঝখানে, সোহরাওয়ার্দী যখন হঠাৎ করেই আইনমন্ত্রীর
পদ নিয়ে নিলেন তখন শেখ মুজিব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এটা সত্য, কিন্তু তাতে সম্পর্কের
ক্ষেত্রে কোনো বিচ্ছেদ ঘটেনি; সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এবং নিজে আতাউর রহমান
খানের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ববঙ্গীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার পর শেখ মুজিব পুরোপুরি সোহরাওয়ার্দীর
পক্ষেই চলে গিয়েছিলেন। বস্তুত, ভাসানী তখনই শত্রুপক্ষে পরিণত হল।
১৯৬৩ সালের শুরুতেই আওয়ামী
লীগ পুনরুজ্জীবিত হলো শেখ মুজিবের হাত ধরে এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে এবার মুজিব আর
সোহরাওয়ার্দীর অবস্থানে নেই। ১৯৬২-এর ডিসেম্বরে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে
যোগাযোগ করে তিনি জানিয়েছেন পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করা ছাড়া পরিত্রাণের আর কোনো উপায়
তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। এরপরে তিনি আগরতলায় যাওয়ার সেই দুঃসাহসিক কাজটি করেছেন। যেটিতে
বোঝা যায় তিনি কতটা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার প্রশ্নে। লন্ডনেও গিয়েছেন সোহরাওয়ার্দীকে
পার্টি পুনরুজ্জীবিত করার আবশ্যকতা বোঝাতে এবং একই সঙ্গে ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করা
যায় কি না সেটা দেখতে। নিজের হাতে ইশতেহার লিখে ও ছেপে অনুগতদের সাহায্যে বিলি করার
উদ্যোগ নিয়েছেন। এরপরই তো এসেছে তাঁর বহুল কাঙ্খিত ছয় দফা।
কিন্তু তাই বলে তিনি যে
তাঁর পূর্বতন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে যুক্ত হবেন সেটা
ঘটেনি কারণ ভাসানীর চিনাপন্থি কট্টর কমিউনিস্ট আইডলজি যা আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে
ছিল সরাসরি। তাই, আসলে মোটেই সম্ভব ছিল না ঘটা। তার কারণ যতই দুঃখী মানুষের দুঃখ ঘোচানোর
চেষ্টা করুন না কেন তার পক্ষে কম্যিউনিজম-বিপ্লবী হওয়াটা সম্ভব ছিল না। ভাসানী
যেভাবে কেবল সমাজতন্ত্রীদেরই নয়, চিনাপন্থি কমিউনিস্টদের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন
মুজিবের পক্ষে তেমনটা হওয়ার কোনভাবেই সম্ভব নয়, তা তিনি হনও-নি।
১৯৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের
প্রার্থী মনোনয়নের সময়ে সোহরাওয়ার্দী সতর্ক ছিলেন কমিউনিস্টরা যাতে ঢুকে না পড়ে সে
বিষয়ে। আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে তখন কমিউনিস্টরা কাজ করছিলেন; তাদের মনোনয়ন দেওয়ার
ব্যাপারে মুজিবের আপত্তি ছিল না। কিন্তু ন্যাপ গঠনের সময়ে তিনিও কমিউনিজমপন্থিদের তৎপরতার
প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েন। তখন তিনি রীতিমতো সোহরাওয়ার্দীপন্থি। তাছাড়া সোহরাওয়ার্দীর সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা
নীতির ব্যাপারে তাঁর যে খুব একটা আপত্তি ছিল তাও নয়। সোহরাওয়ার্দী আরও কিছুদিন রাজনীতিতে
সক্রিয় থাকলে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার প্রশ্নে মুজিবের সঙ্গে হয়তো লিডারের দ্বন্দ্বই
দেখা দিত এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি হয়তো বেরিয়ে আসতেন। সংসদীয়
‘গণতন্ত্রে’ই মুজিবের আস্থা ছিল দৃঢ় বলেই এইসব ঘটনা প্রমাণ করে, যা ছিল পাকিদের থেকে
আমাদের স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষার। আমরা বাঙালি, সবার প্রথম আমাদের পরিচয় ও মূল স্বাধীনতার
ম্যান্ডেট বাঙালি হিসেবে আমাদের নিজেদের পরিচয় পাওয়া, নিজেদের ভূখণ্ডে নিজেদের জাতীয়তা
নিয়ে বেঁচে থাকা তাই তো মুজিববাদের ৪-স্তম্ভের একটি হল ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’।
সোজাভাবে বললে বাঙালির
৯০ ভাগ দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের কাছে গণতন্ত্রের মত ব্যাপারটি অনেকটা বুর্জোয়া সম্বলিত
বলেই দেখা যায় কারণ ডেমোক্রেসি জন্ম দেয় কঠোর ক্যাপিটালিজম নীতির। এর জন্য জনমানুষের
নেতা শেখ মুজিব ধীরে ধীরে বিশ্বাসী হন সমাজতন্ত্র বা সোশ্যালিস্ট আইডোলজিতে, যা কমিউনিজম
থেকে অনেকটাই আলাদা। তাই আমাদের স্বাধীনতার একটি স্তম্ভ ‘সমাজতন্ত্র’।
৪ স্তম্ভ নিয়ে তো আলোচনা
হল, এবার আসি কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ৪ ম্যান্ডেটের নাম ‘মুজিববাদ’ হল।
সিম্পল: তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিকামী বাঙালির নেতা ছিল এককভাবে শেখ মুজিব।
সে ছিল জনমানুষের একমাত্র নেতা যাঁর অস্তিত্বে এই আপামর খেটে খাওয়া বাঙালি তাদের মুক্তির
ম্যানিফেস্টেশন দেখত। প্রিন্সটনের অধ্যাপক গ্যারি যে ব্যাস তার বাংলাদেশের স্বাধীনতায়
হেনরি কিসিঞ্জার ও তৎকালীন ডেমোক্রাটদের ডেভিল-স্বরূপ ভুমিকা তুলে ধরে বই ‘দ্যা ব্লাড
টেলিগ্রাম’-এ লিখেছেন “The Bengalis saw the manifestation of their identity
in Sheikh Mujib. He was a man who eagerly believed in People's power. He firmly
and blindedly believed that ‘his Bengalis’ love him unconditionally.”
তাইতো স্বাধীন বাংলাদেশের
সংবিধানে বঞ্চিত ‘পূর্বপাকিস্তানি’ এই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ম্যান্ডেটই হলো মুজিববাদ,
কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই ওয়েস্টপাক থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে এই বাঙালি জাতির আল্টিমেট
আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে সফল হয়েছেন; যা পারেননি সোহরাওয়ার্দী বা ভাসানি এবং অনেক
প্রমাণ বলে, ‘বাংলাদেশ’-এর জন্ম হয়ত তাদের আইডলজিরও পরিপন্থী।
এখন যারা বলেন ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ বা মুজিববাদ ও মুজিবকে তেমন মানতে প্রয়োজনবোধ করেন না, তাদের নিশ্চই পরিবারের কেউ কড়া মুসলিম লীগার বা রাজাকার এবং একইভাবে তারাও বাংলাদেশ ও তাদের নিজ জাতির স্বাধীনতা স্বীকারে তাদের লজ্জাবোধ-দ্বিধাবোধ হয়।
লেখক ভাগীরথি ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের চলমান স্বাধীনতা বিরোধী
ও পাকিস্তানপন্থি অবস্থানের কারণে ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন তার এই আর্টিকেলে। নতুন প্রজন্ম
বিশেষ করে বহুল চর্চিত জেন জি প্রজন্মের একজন উজ্জ্বল প্রতিনিধি তিনি, মুক্তিযুদ্ধের
আলপথ থেকে পথ হারাননি তিনি।