‘জয় বাংলা’ বলার কারণে চাকরিচ্যুত করা হলো বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দীন আহমেদকে । রাজধানী ঢাকায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পর গণপিটুনির শিকার হয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সিরাজগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাজাবাড়িতে এক মানববন্ধনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে ক্ষমা চাইলেন প্রধান শিক্ষক।কয়েকদিন আগে এক বিএনপি নেতা শাসালেন এই বলে, ‘কেউ জয় বাংলা স্লোগান দিলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে।’ ভাবছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আমরা কি পরাজিত হয়েছিলাম? নিম্নে যে ইতিহাস তুলে ধরছি তার সাথে সে সময়ের মধ্যপর্যায়ের এক ছাত্র নেতা এবং পরবর্তীতে যুদ্ধের মাঠের একজন সংগঠক হিসেবে স্মৃতি থেকে।
‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি ছিল বাঙালির ভাগ্য গঠনে চেতনা, ঐক্য, দেশপ্রেম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের নির্মম শোষণ, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের লড়াইয়ে এই আইকনিক স্লোগানটি অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই স্লোগান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে, এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই স্লোগান মুখে নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেন।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গোপন ছাত্র সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ‘জয় বাংলা’ নামে একটি হাতে লেখা সংবাদ প্রকাশ করত।
১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালীন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের দুই সদস্য—আফতাব উদ্দিন আহমেদ এবং চিস্তি শাহ হেলালুর রহমান—‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। ছাত্রলীগ নেতা আফতাব ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং চিস্তি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও দর্শনের শিক্ষার্থী। আফতাবের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার একটি নিজস্ব পটভূমিকা ছিল। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রউফের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ফিরে আসার পর রউফ মধুর ক্যান্টিনে অন্যদের সঙ্গে তার সফরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, জিএম সৈয়দের নেতৃত্বে সিন্ধুতে একটি আন্দোলন চলছে এবং এর মূল স্লোগান ছিল ‘জয় সিন্ধ’। আলোচনার এক পর্যায়ে আফতাব বলেন, তারাও ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করতে পারেন। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে তিনি নিজেই স্লোগানটি দেন। এর মধ্য দিয়ে ‘জয় বাংলা’ আন্দোলিত হতে থাকে।
১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্ররা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সমাবেশে এই স্লোগান দেয়। সেখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন। এর দুই সপ্তাহ পর ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে উচ্চারিত হতে থাকে ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি। সমাবেশ পরিচালনাকারী সিরাজুল আলম খান মঞ্চ থেকে বারবার স্লোগানটি দিতে থাকেন।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করে, যেখানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ উন্মোচন করেন। ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান। পরে বিতরণ করা লিফলেটের শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীনতার ইশতেহার: জয় বাংলা’।
ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন দেশ—ভারত ও পাকিস্তান (পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে গঠিত)। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন শাসকদের অধীনে বাঙালিদের কাছে স্বাধীনতা অধরা থাকায় ‘জয় বাংলা’ ধীরে ধীরে স্লোগান হিসেবে পুনরুত্থিত হয়। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর নাম ছিল ‘জয় বাংলা বাহিনী’, যার প্রধান ছিলেন এএসএম রব। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সব সদস্যকে রাজপথে নামতে বলা হয়েছিল এবং পরিষদের সব সদস্যের কাছে নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাইক্লোস্টাইল পেপার ‘জয় বাংলা’ প্রকাশিত হয়েছিল। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে এসেছে, ততই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’র বদলে সর্বত্র ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে—বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর ১৯ মিনিটের মহাকাব্যিক ভাষণটি ‘জয় বাংলা’ দিয়ে শেষ করেছিলেন, এরপর থেকে স্লোগানটি ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। এই স্লোগান শুনে উপস্থিত জনতা গর্জে ওঠে নতুন উদ্যমে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার প্রথম বেতার ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ বলে। পরের দিন এটি রেডিওতে প্রচারিত হয়।
‘জয় বাংলা’ এমন একটি স্লোগান যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণকে তাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রবল ভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল। এর আগে বাঙালি কখনো এত তীব্র, সংহত এবং তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয় নি যাতে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য এবং জাতীয় আবেগ । ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর অবধারিত ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে জয় উদযাপন করত।
পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালেহ তার ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ গ্রন্থে লিখেছেন “ধৃত মুক্তিযোদ্ধাটিকে আমরা বললাম তুমি জিন্দাবাদ বললে তোমাকে আমরা ছেড়ে দিবো”। তার জবাবে সে বললো, “শহীদ হবো তবু জিন্দাবাদ বলবো না”। তাকে গুলি করার পূর্ব মুহূর্তে সে বললো, “আমাকে এক মিনিট সময় দাও”। সে তখন এক টুকরো মাটি কপালে নিয়ে বললো, “হে আমার বাংলার মাটি আমি তোমার মুক্তির জন্য রক্ত দিয়ে যাচ্ছি। আমার রক্তে তুমি পবিত্র হবে। আমি তোমায় মুক্ত করে যেতে পারলাম না। আমার সহযোদ্ধারা তোমায় মুক্ত করবে। জয় বাংলা”।
২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে বলে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘জয় বাংলা জাতীয় ঐক্যের স্লোগান। জয় বাংলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় স্লোগান এবং জয় বাংলা ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
বাঙালির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক স্লোগান ‘জয় বাংলা’ একাকার হয়ে মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে এই স্লোগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যে গতি ও শক্তি সঞ্চার করে তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। ছোট্ট দুটি শব্দের একটি স্লোগান কীভাবে পুরো একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, একটি জাতিকে স্বাধিকারের পথে উদ্বুদ্ধ করে, নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে, দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি জনতাকে অভিন্ন চেতনার আলোকে উজ্জীবিত করে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তারই জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। জয় বাংলা কোনো দলের একক স্লোগান নয়, বরং এ স্লোগান আপামর মুক্তিকামী বাঙালির। জয় বাংলা বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্লোগান। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। জয় বাংলা স্বাধীনতার স্লোগান। জয় বাংলা বাঙালির ‘মুক্তির’ স্লোগান। জয় বাংলা এ দেশের মানুষের ঐক্যের স্লোগান। জয় বাংলা আমাদের অস্তিত্বের স্লোগান। সর্বোপরি আমাদের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’।
১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে এ স্লোগান। এর আগে বাঙালি কখনো এতটা তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগানে অনুরণনীত হয়নি, যেখানে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এ দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মের, বর্ণের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবার পরিচয় ছিল একটাই—‘জয় বাংলার লোক’। বস্তুত, ‘জয় বাংলা’র ডানায় ভর করেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। ‘জয় বাংলা’র প্রকম্পিত ধ্বনিতেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ, সার্বভৌম পতাকা। যে স্লোগান হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র, স্বাধীনতার প্রথম আনন্দধ্বনি, তা বয়ে যাবে প্রজন্মান্তরে।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়
কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধ রাতে
নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়...’
কে শোনেনি এই গান? সর্বাধিক শ্রোতাশ্রুত গানের তালিকা করলে নিঃসন্দেহে এ গান আসবেই। এটি শুধু গান নয়, এমন কিছু কথা সম্মিলন, যার মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে হানাদার বধে এগিয়ে যান বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির জনতা। গানটি এমন এক সুরের গাঁথুনি, যা বাংলার মুক্তিপিপাসু মানুষের চেতনায় আগুন ধরায়। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটিকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণসংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে এই গানকে আরাধ্য করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায় সমগ্র বাঙালি। এই গান স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা সংগীত; জাতীয় স্লোগানও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করত। “জয় বাংলা, বাংলার জয়” গানটি এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত হিসাবে প্রচারিত হতো।
মোজাম্মেল খান : বহুবিদ পুরস্কারে ভূষিত কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক, সিনেটের সাবেক স্পীকার, মানাবাধিকার কর্মী এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক।